সামরুজ্জামান (সামুন), কুষ্টিয়াঃ কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ফকির লালনের মূল জায়গা ভাবনগর। তাঁর ভক্তরা শুধু মানুষের ভজন করে, নেশার নয়। লালনের ভাবধারা যুগে যুগে মেয়ে সঙ্গী ও নেশা দ্রব্য দিয়ে বিচ্যুতি করা হয়েছে।
ফরহাদ মজহার আরও বলেন, লালন সাঁইয়ের ফকিরি মতবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে ‘নবপ্রাণ’ ও লালন একাডেমি একসঙ্গে চলবে। তিনি সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান রেখে বলেন, লালন একাডেমি ফকিরদের প্রতিষ্ঠান, ফকিরদের হাতেই ছেড়ে দিন।
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় ১৩৪ তম লালন তিরোধান দিবসের দ্বিতীয় দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ও মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার এসব কথা বলেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, মানুষের ধারণা, মাজারে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়া হয়। তাই আজকে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর মাজার ভাঙা হচ্ছে। মাজার ভাঙা ফৌজদারি অপরাধ। প্রশাসনকে বলব, এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিন। লালনের ফকিরি ভাবের সত্য প্রকাশ না হওয়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙার দায় লালন একাডেমিকে নিতে হবে।
ফকির লালনের মূল জায়গা ভাবনগর উল্লেখ করে এই কবি বলেন, লালনের ভক্তরা শুধু মানুষের ভজন করে, নেশার নয়। ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হতে হবে। লালনের চর্চা সঠিকভাবে করতে নেশা হবে ভাবের, নেশা প্রজ্ঞার, নেশা হবে মানবতার।
ফরহাদ মজহার বলেন, ফকির লালনের ভাবধারা যুগে যুগে মেয়ে সঙ্গী ও নেশা দ্রব্য দিয়ে বিচ্যুতি করা হয়েছে, যার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ভাব সাধকের এই পবিত্র জায়গায় এ ধরনের প্রচলন চলতে দেওয়া যাবে না। যেমনভাবে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে আগস্টের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে আজকের প্রজন্ম সাধনার জায়গায় বদ জাতিকে মেনে নেবে না। তাদেরও বিদায় করবে।
মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইকে বাউল সম্রাট হিসেবে আখ্যা দিয়ে ক্ষতি করা হচ্ছে বলে দাবি করে এই চিন্তক বলেন, ফকির লালন সাঁই মানবসেবার ব্রত নিয়ে অসংখ্য গান লিখে গেছেন। তাঁর এই অমর সৃষ্টি সংগীতে কখনই বাউল শব্দ ছিল না। তাঁর গান কোনো ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইকে যুগে যুগে বাউল সম্রাট উল্লেখ করে তাঁর মানবতার কল্যাণের ফকিরিবাদ মতামতকে ক্ষতি করা হচ্ছে।
ফরহাদ মজহার বলেন, বাউল শব্দটি কোনো অর্থ বহন করে না, বরং ফকিরদের সঙ্গে যুক্ত করে ফকিরিবাদকে খাটো করেছে। এদিকে যেমন তাঁর সৃষ্টি ছড়িয়েছে বিশ্বে, তেমনি তাঁকে নিয়ে হচ্ছে উন্নতর গবেষণা। মূলত নদীয়ার পাঁচটি ঘরের ধারাকেই লালন ফকিরিবাদের মূলধারা হিসেবে প্রচলন রেখে গেছেন। সমাজের হানাহানি দূর করে মানুষকে শান্তির পথ দেখিয়েছে লালন সাঁইয়ের মানবতাবাদ।
ফরহাদ মজহার বলেন, নদীয়ার প্রথম ফকির হলো চৈতন্য। লালন সাঁই চৈতন্যের ভাবধারায় নিজেকে ফকির হিসেবে গড়ে তোলেন। লালনের এই প্রসার কোনোভাবেই ভারত মেনে নেয়নি। যুগে যুগে ভারত পরিকল্পিতভাবে এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে দেয়নি, বর্তমানেও দিচ্ছে না। দিল্লি ক্রমাগতভাবে আমাদের নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই মহাজ্ঞানী মহাত্মা লালনের সৃষ্টির কীর্তি আজ আর কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ীর মধ্যে আবদ্ধ নেই। লালন সাঁই জাত-ধর্মের সীমাবদ্ধতার বাইরে মানুষকে সবার ওপর তুলে ধরেছেন। বাংলার ভাবজগৎ বর্তমান বিশ্বে অনেকটাই সমৃদ্ধ।
ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবসের তিন দিনের অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন গতকাল শুক্রবার রাতে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোছা শারমিন আখতারের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, কুষ্টিয়া জজ কোর্টের সাবেক পিপি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহম্মদ, ছাত্র-জনতা প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান, তৌকির আহমেদ প্রমুখ।
আলোচনা সভা শেষে মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন লালন একাডেমিসহ অনুষ্ঠানে আসা বিভিন্ন শিল্পীরা। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই সংগীত পরিবেশো।