সঞ্জিব দাস, গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধিঃ ‘কুরআনের হাফেজ বানাতে চেয়েছিলাম রাব্বিকে। সে ১০ পারা কোরআন মুখস্থ করেছিল। হঠাৎ ১৯ জুলাই পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হয় রাব্বি। এ যন্ত্রণা আমি কোথায় রাখি।’ হাউ মাউ করে কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়া রাব্বির বাবা জুয়েল সিকদার।
তিনি বলেন, ‘রাব্বি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশের একটি বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমার ফুটফুটে সুন্দর ছেলেটিকে। রাব্বি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে- এটা যে আমি মেনে নিতে পারছি না।’
রাব্বির মা ফিরোজা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে কোরআনের হাফিজ বানামু। তাইতো ঢাকায় আইছিলাম। রাব্বিকে মাদরাসায় ভর্তি করাইছিলাম। ১০ পারা কুরআন মুখস্থ করেছিল রাব্বি। আমার ছেলেতো কোনো দোষ করে নাই। ওতো ছোট মানুষ, কোনো রাজনীতি করে না। ওরে কেন মারল, কার কাছে বিচার চাইমু? আহারে, আমার বাবাডারে আমি এখন কোথায় পামু।’
রাব্বির বাবা-মা সন্তানদের সুখের কাথা ভেবে ঢাকায় এসেছিলেন। বাসা নিয়েছিলেন মিরপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদসংলগ্ন এলাকায়। রাব্বির বাবা জুলেল সিকদার একটি মোজাইক টাইলসের দোকানে কাজ করতেন। গ্রামের বাড়ি তাদের পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের বাঁশবাড়িয়া গ্রামে।
জানা গেছে, ২০২১ সালে তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তারা ঢাকায় আসেন। ছোট ছেলে রাব্বি। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল মিরপুরের তা’লীমুল ইসলাম মাদরাসায়। বাসা থেকে মাদরাসায় হেঁটে যেতে সময় লাগতো মাত্র ৭-৮মিনিট। রাব্বি প্রতিদিন মসজিদে ও মাদরাসায় নামাজ আদায় করে।
ঘটনার দিন ১৯ জুলাই শুক্রবার। রাত ৮টার দিকে মাদরাসার কাছাকাছি ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের সামনে দিয়ে যখন ছাত্র-জনতার মিছিল যাচ্ছিল, তখন রাব্বিসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র তা দেখার জন্য সেখানে যায়। শুরু হয় তখন পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি। অন্য ছাত্ররা দৌঁড়ে গেলেও রাব্বি একটি ভ্যানগাড়ির নিচে আশ্রয় নেয়। তখনই পুলিশের গুলি এসে লাগে রাব্বির বুকে। এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় বুক। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাব্বি। ঘটনাস্থল থেকে রাব্বির লাশ পুলিশ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ছাত্র জনতার প্রতিবাদে সেটি করতে পারেনি পুলিশ। ততক্ষণে স্থানীয় লোকজন রাব্বির লাশ আজমল হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক রাব্বিকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে, রাব্বির বাবা জুয়েল সিকদার ওই রাতেই লাশ নিয়ে পটুয়াখালীর গলাচিপা আসতে চান। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। তারা বলেন, ‘মিছিলে তোমার পোলা গেল কেন? তোমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। একদিকে পুত্র হারানোর শোক, অন্য দিকে আওয়ামী লীগ নেতার মামলার ভয় দেখানো। পটুয়াখালীর গলাচিপায় নিজের ভিটায় দাফন করা হলো না রাব্বির লাশ। রাব্বিকে কবর দেয়া হলো মিরপুর-১৩, শিশু কবরস্থানে।’
গলাচিপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) নাসিম রেজা জানান, বৈষাম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গলাচিপায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে মারা গেছেন ছয়জন, আহতও হয়েছেন ছয়জন।