জাহাঙ্গীর কবির নানক এর স্মৃতিচারণ (২১ আগষ্ট) -ঃ
২০০৪ সালের একুশ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলকে স্বাভাবিক মনে হয়নি যুবলীগের তখনকার চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানকের।
শুক্রবার (২০ আগস্ট) ওই সময়কার স্মৃতিচারণ করে একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদ মাধ্যমকে তিনি এ কথা বলে।
জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আওয়ামী লীগের সমাবেশ থাকলে সবসময় পুলিশের আনাগোনা থাকত। কিন্তু সেদিন সমাবেশস্থলে কোনো পুলিশ দেখিনি। অথচ গ্রেনেড হামলা হওয়ার পরে দেখি, পুলিশ এসে সমাবেশস্থলে উদ্ধার কাজ না করে উল্টো হতাহতদের লাটিচার্জ করতে। আর টেয়ারশেল নিক্ষেপ করতে’।
একুশের আগস্টের গ্রেনেড হামলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নানক জানান, ‘গ্রেনেড হামলার পর নেত্রীর অবস্থা জানতে তার বাসভবন ধানমণ্ডির সুধাসদনে যাই। গিয়ে দেখি তিনি নির্বাক তাকিয়ে আছেন। তার চোখ দিয়ে অশ্র ঝরছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন. ‘বাইচা আছো।’ পরে নির্দেশ দিলেন হাসপাতালে হাসপাতালে হতাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। তার পর নেত্রীর নির্দেশ মতো কাজ শুরু করি।’
তিনি গ্রেনেড হামলার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘পাকিস্তান কখনো চায় নাই বাংলাদেশ একটি সফল রাষ্ট্রে পরিণত হোক, সাফল্য অর্জন করুক। আর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে, তখনই এদেশ সমৃদ্ধশালী হয়। কাজেই এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে হত্যা করতে পারলে এদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই একুশের আগস্টে হামলা করা হয়। তখন ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।’
নানক বলেন, ‘এর আগে থেকেই আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদেরও হত্যা করা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী এমএস কিবরিয়াকে গ্রেনেড দিয়ে হত্যা করা হয়। শ্রমিক নেতা এম কে আহসান উল্লাহ মাস্টার, নাটোরের অ্যাডভোকেট মনতাজ উদ্দিন, চট্টগ্রামের গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী, সাংবাদিক মানিক সাহা, খুলনার বাবুলসহ প্রায় সারা দেশে ২১ হাজার যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকে হত্যা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হযরত শাহজালালের (রহ.) মাজার জিয়ারত করতে গেলে তখনকার বিট্রিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনের্ড হামলা হয়। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও হতাহত হয়েছিলেন অনেকেই। বিএনপি-জামায়াতের ধারাবাহিক এসব সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে শেখ হাসিনা ২১ আগস্টে একটি শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি দেয়। সেদিন আমাদের প্রস্তুতিও ছিল। সেদিন সমাবেশস্থল ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে হয়েছিল। একটি গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সবসময় আওয়ামী লীগের মিটিং-মিছিল হলে তাতে পুলিশ মোতায়েন রাখা হতো। কিন্তু সেদিন দেখেছি,সমাবেশস্থলে পুলিশের কোনো আনাগোনা নাই। নেত্রী আসার আগেও কোনো পুলিশ দেখিনি। ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের অফিসের নিচতলায় ছিল যুবলীগের কার্যালয়। আমরা সেখানে ছিলাম। আমরা এটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি’।
তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা সেদিনের সেই সমাবেশে আসবেনই। তাই শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত নিজস্ব বাহিনীর সদস্যরা সমাবেশস্থল দেখে গেলেন। সমাবেশের জন্য আমাদের মঞ্চও তৈরি করতে দেয়া হয়নি। মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করলেন। বেলা ২টার পর পরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা আসতে শুরু করলেন। সমাবেশে যোগ দিতে বেলা ১২টা থেকে লোক আসতে শুরু করে। এরই মধ্যে সমাবেশস্থল লোকে-লোকারণ্য। সেদিনের মিটিংয়ে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক।’
নানক বলেন, ‘সুধাসদন থেকে খবর পেলাম- নেত্রী আর ১০মিনিটের মধ্যে রওয়ানা দিবেন। তখন চারটা থেকে সোয়া চারটা বাজে। আমরা সবাই বের হয়ে গেলাম। কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে গেলেন, আর আমরা এগিয়ে গেলাম। পীর ইয়ামেনি মার্কেট থেকে নূর হোসেন স্কয়ার অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে গেলাম। পীর ইয়ামেনি মার্কেটটা ছিল এক বিএনপির নেতার। এ জায়গাটাকে আমরা কখনো নিরাপদ মনে করতাম না। আমরা সব সময় নেত্রীর গাড়িটাকে ওই জায়গা থেকে ঘেরাও করে নিয়ে আসতাম। সেদিন যুবলীগের নেতৃত্বে ২ হাজার নেতাকর্মী নেত্রীর গাড়িটি ঘেরাও করে নিয়ে আসলাম। আমরা যখন আসলাম, তখন আর ভেতরে ঢুকতে পারলাম না। সমাবেশের প্রবেশমুখে কাটাতাঁরের ব্যারিকেড দেয়া ছিল। এই জায়গাটিতেই দাঁড়িয়ে গেলাম। নেত্রীর গাড়ি ভেতরে ঢুকে দেয়া হয়। কেন আমরা ঢুকতে পারলাম না? কারণ, এর পরে সব মহিলা। মহিলাদের মধ্য দিয়ে গেলে বিশৃঙ্খলা হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, নেত্রী মঞ্চে উঠার সঙ্গে সঙ্গে মায়া ভাই মাইকে নাম ঘোষণা করেন। নেত্রী বক্তৃতা করলেন। সেদিন শান্তির সমাবেশ শেষে আমাদের একটি মিছিল করার কথা ছিল। নেত্রী ‘জয় বাংলা’ বলে বক্তৃতা শেষ করলেন। মায়া ভাই ঘোষণা দিলেন এখন আমাদের মিছিল হবে’। নেত্রী গাড়িতে তৈরি অস্থায়ী মঞ্চ থেকে নামবেন, এমন সময় এক ফটোসাংবাদিক অনুরোধ করলেন, ‘নেত্রী, আমরা ছবি নিতে পারিনি।’
নেত্রী তাদের ছবি তোলার সুযোগ দিতেই ক্যামেরার ফ্লাস জ্বলে উঠল। এটা কিন্তু দুই-তিন মিনিটের কথা বলছি। ঘটনা কিন্তু ৪-৫ মিনিটের মধ্যে। হঠাৎ শুনি গুলির শব্দ। তখন ভাবিনি গ্রেনেড। তখন মনে করেছি, এগুলো বড় বড় বোমা আর গুলির শব্দ। সমাবেশে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ যে যেদিকে পারল উর্ধ্বশ্বাসে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটতে থাকল। আমরা পীর ইয়ামেনি মার্কেটের সামনে রাস্তার মুখে। কর্মীরা আমাদের মার্কেটের ভেতরে নিয়ে কলাপসিবল গেট আটকিয়ে দেয়। তখন দেখলাম, পুলিশ সমাবেশস্থলের দিকে টিয়ারশেল ছুড়তে লাগল। আর লাঠিচার্জ করতে লাগল।’ তিনি বলেন, তখন নেত্রীর অবস্থা জানতে আমরা মার্কেট থেকে বেরিয়ে গেলাম। পথেই দেখা হলো নেত্রীর এপিএস আলাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- ‘নেত্রী কই’। সে বলল, ‘নানক ভাই অস্থির হয়েন না, মানুষগুলোকে আগে বাঁচান। নেত্রী সেইফলি বেরিয়ে গেছেন।’
তারপর দেখি অতিচেনা কালো পিচঢালা রাস্তা রক্তে লাল হয়ে গেছে। রাস্তায় রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। আহত মানুষের আহাজারী, চিৎকার। বাঁচাও বাঁচাও বলে আকুতি। কিন্তু জানেন, এর মধ্যে অনেকে চিৎকার করে বলছে- ‘নানক ভাই, আজম ভাই বলেন নেত্রীর খবর কী? নেত্রী বাইচা আছে?’ সে কিন্তু রক্তে প্লাবিত হচ্ছে। আমরা সবাইকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করলাম। হাসপাতালে পাঠালাম।’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে বিএনপির চিকিৎসকদের সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমরা নেতাকর্মীদেরকে ভ্যান গাড়িতে করে, রিকশা করে হাসপাতালে হাসপাতালে পাঠাতে থাকলাম। সবাইকে পাঠানোর পরে আমরা আর অফিসে না ঢুকে চলে গেলাম নেত্রীর বাসভবন সুধাসদনে। নেত্রীর খবর জানা দরকার। সুধাসদনে প্রবেশ করে দেখি নেত্রী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ওই সময় নেত্রীর গলা ধরে শেখ রেহানা অঝোঁর ধারায় কান্না করছেন। আর নেত্রীর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে।
আমি যখন সুধাসদনে গেলাম, তখন পর্যন্ত কেউ সেখানে যায় নাই। ড্রয়িং রুমে ঢোকার আগে একটা ওয়াশরুম আছে। নেত্রী আমাকে জিজ্ঞাসা করতেছে- ‘বাইচা আছো। তুমি আছো, আজম কই। আজম কী বেঁচে আছে?’ আমি বললাম,‘আপা বেঁচে আছে। ওয়াশরুমে গেছে।’
আমি আপার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখে বলতে থাকলাম- ‘এই আজম, আপা খুঁজতেছে, তাড়াতাড়ি আসো।’ নেত্রী মুখে হাত দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু চুপ থেকে নেত্রীকে বললাম- ‘নেত্রী বলেন, আর এই সরকারকে রাখা যায় না। এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য সারা দেশ বন্ধ ঘোষণা করব, কর্মসূচি দেব।’
নেত্রী বললেন, ‘নানক, আজম। আমি দেশের জন্য রাজনীতি করি। আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করি। আমার জন্য কত মানুষ আর করবে’? নেত্রীর কথা শুনে অশ্রু ধরে রাখতে পারলাম না। আমরা বললাম, ‘আপা, ’৭৫-এ মরলেন না। এবারো আল্লাহ আপনাকে রেখে দিয়েছেন দেশের জন্য কিছু করার জন্য।’
তখন নেত্রী আমাদের বললেন, ‘এখনই চলে যাও। হতাহতদেও সমস্ত হাসপাতালে হাসপাতালে চিকিৎসা করাও। আমার একটা মানুষ যেন বিনা চিকিৎসায় আর মারা না যায় সেই ব্যবস্থা কর। আমাদের দুই বোনে যা আছে হাতে, কানে- সব বিক্রি করে হলেও চিকিৎসা করতে হবে। আমি খবর পেয়েছি যে, ড্যাবের সব ডাক্তাররা হাসপাতাল থেকে সড়ে গেছে চিকিৎসা যেন না হয়। যাতে বিনা চিকিৎসায় আহতরা মারা যায়। আমাদের ডাক্তারদের বলো, হাসপাতালে চলে যেতে।’
তারপর আমরা বেরিয়ে গেলাম।চিকিৎসকদের ফোন করছি আর হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছি। সেদিন রাতে আবার সুধাসদনে গেলাম। তখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। নেত্রী বললেন- ‘কালকে তোমরা দুইজনে মায়াকে নিয়ে ওই এলাকাটা (সমাবেশস্থল) একটু সংরক্ষণ করো’।
নানক বলেন, পরের দিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে সমাবেশস্থলে গিয়ে দেখলাম, সেখানে পুলিশ রয়েছে। তারা আমাদেরকে আমাদের দলীয় অফিসে ঢুকতে দেবে না। আমরা চিৎকার করে বলতে লাগলাম- ‘মরাকে আর মারার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। গুলি করেন বুকে। তারপরও ঢুকবো।’এক সময় ওয়াকি-টকিতে কার সঙ্গে যেন কথা বলল পুলিশ। আমরা ধাক্কা দেয়ার পর তারা সরে গেল। আমরা যখন ঢুকলাম, তখনও রক্ত শুকায় নাই। ছুপ ছুপ রক্ত পড়ে আছে। যুবলীগ অফিসে ঢুকে দেখি আঙ্গুল পরে আছে। পা ফেলতে পারছি না।
মানুষের রক্তের উপর দিয়ে পা দিয়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কী দিয়ে ঘেরাও করব? অফিসে দলীয় কর্মসূচিতে ব্যবহার করা লাল এবং কালো ব্যানারের কাপড়গুলো সংরক্ষণে রাখতাম। ওইগুলো দিয়ে আর ব্যানারের লাঠি দিয়ে সমস্ত এলাকা ঘেরাও করলাম। যেসব স্থানে গ্রেনেড ব্লাস্ট হয়েছে, সেসব স্থানে কালো কাপড়ের নিশানা লাগালাম। সেদিন চাকা পাংচার হয়ে মঞ্চ হিসেবে তৈরি করা ট্রাকটি সেখানেই পড়ে ছিল।
আগের দিন যখন সুধাসদনে গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম- নেত্রীর বুলেটপ্রোফ গাড়িটাও পাংচার হয়েছে, গুলির চিহ্ন রয়েছে। পরের দিন সংরক্ষিত সবাবেশস্থলে গিয়ে দেখি চাকা পাংচার হওয়া ট্রাক নাই। জুতা-সেন্ডেলও নাই, যে নিশানা দিয়েছিলাম তাও নাই, কোনো রক্তও নাই। পরে শুনলাম সিটি করপোরেশনের ক্লিনাররা সব ধুয়ে-মুছে ফেলেছে। র্যাকার এসে ট্রাক নিয়ে গেছে। কোনো আলামত তৎকালীন বিএনপি সরকার সংরক্ষণ করেনি।