আলিফ হোসেন, তানোর -ঃ- রাজশাহীতে শুরু হয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ। গত এক সপ্তাহ ধরে ৪০ থেকে ৪২ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে তাপমাত্রা উঠানামা করছে। গত কয়েক দিন ধরেই রাজশাহীর ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। এই তাপপ্রবাহে ঝরে পড়ছে গাছের ছোট ছোট আম আর লিচু। পুড়ছে মাঠের বোরো ধান। তবে আম লিচু ঝরে পড়া ঠেকাতে সকাল-বিকেল দুইবেলা গাছের গোড়ায় পানি দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ। সেচ দিয়ে মাঠের বোরো ধানের খেত ভিজিয়ে রাখতে বলা হচ্ছে। কিন্তু মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে পল্লী বিদ্যুতের লোডশেডিং। এতে সময় মতো ও কাঙ্খিত সেচের পানি পাওয়া যাচ্ছে না। অধিকাংশ এলাকায় বোরো খেত ফেটে চৌচির।
রাজশাহী কৃষি বিভাগ সুত্র জানায়, এই বছর জেলায় প্রায় ৬৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান, প্রায় ১৯ হাজার ৫৭২ হেক্টর জমিতে আমবাগান এবং প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে আছে লিচু বাগান। তানোরে এই বছর প্রায় সাড়ে ১৩ হেক্টর জমিতে বোরো, প্রায় ৪২৫ হেক্টর জমিতে আম বাগান ও বেশ কিছু লিচু বাগান রয়েছে। কিন্তু প্রচন্ড রোদ ও তাপপ্রবাহের কারনে গাছের আম ও লিচু ঝরে পড়ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, কড়ালিকাল পার করে আম ও লিচু এখন পরিণত হতে শুরু করেছে। মাঠে মাঠে বোরো ধান গাছে শীষ আসতে শুরু করেছে। আবার কোনো কোনো খেতের ধান পাকতে শুরু করেছে। কোথাও গাছের ওপরের পাতা বাদামি বর্ণ ধারণ করে পুড়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও বোরো কাটা শুরু হয়েছে।
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, তীব্র খরা ও তাপপ্রবাহে ধানগাছের ওপরের পাতা পুড়ে যাচ্ছে। তারা বলছেন, অন্য এলাকার তুলনায় রাজশাহী অঞ্চলে ধান চাষ করতে সেচের পানির প্রয়োজন হয় বেশি। কিন্তু বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ থেকে চাহিদা অনুযায়ী পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তীব্র খরায় ধানখেত ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। গত ২৩ এপ্রিল রোববার মোহনপুর উপজেলার ঘাষিগ্রাম ইউপির তুলসিক্ষেত্র বিলে ধারে আব্দুল কাদেরের চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিলেন কয়েকজন কৃষক। দোকানি আব্দুল কাদের বললেন, ‘এমনিতে লম্বা সিরিয়াল ধরে পানি নিতে হয়। এখন কয়েক দিন ধরে আবার বিদ্যুতের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ কারণে সময়মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানি পেতে দেরি হওয়ায় অনেক জমি ফেটে চৌচির হচ্ছে। তানোরের পাঁচন্দর ইউপির ডাঙাপাড়া গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এতই খরা পড়ছে যে আজ পানি দিলে কালকেই জমির পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। দুই দিন পরই পানি দেওয়া উচিত। কিন্তু ডিপে ১০ দিনের আগে কোনো সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না। অতিমাত্রায় লোডশেডিংয়ের কারণে পানির সিরিয়াল পেতে দেরি হচ্ছে।’ তীব্র খরায় গাছেই শুকিয়ে যাচ্ছে লিচু ও আম। বিলকুমারী বিলের ধানচাষি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘নিচু জমিগুলোর ধান ভালো আছে। কিন্তু উঁচু জমির ধানে খুব সমস্যা। সময় মতো পানি দিতে না পারলে ধান হবে না, সব চিটা হয়ে যাবে।
তীব্র খরায় সমস্যার কথা জানালেন মোহনপুর উপজেলার হাটরা গ্রামের আমচাষীরাও। আমচাষি আমিনুল বলেন, ‘খরার কারণে প্রত্যেক থোকা থেকে আম ঝরে পড়ছে। থোকায় ৫টা আম থাকলে কমপক্ষে দু’থেকে তিনটা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ রকম খরা চলতে থাকলে আমের ফলন কমে যাবে। তানোরের তালন্দ ইউপির কালনা গ্রামের লিচুচাষী
বললেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘গাছের গোড়ায় সকাল-বিকেল পানি ঢালছি। তাও লিচুর গুটি রক্ষা করা যাচ্ছে না। গাছের চেয়ে মনে হচ্ছে মাটিতেই বেশি লিচু পড়ে আছে। এখন লিচুর জন্য বৃষ্টির খুব দরকার।
এবিষয়ে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘খরা পড়ছে, কিন্তু এখনই যে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে তা নয়। আম-লিচু তো এমন প্রতিকূল আবহাওয়ারই ফল। খরা হবে, ঝড়-বৃষ্টি, শিলা হবে, এর মধ্যে দিয়ে এগুলো বড় হবে। তবে এখন বৃষ্টি প্রয়োজন। বৃষ্টি হলে পরিবেশটা ঠান্ডা হবে। তখন আর ঝরবে না।এবিষয়ে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, ‘এই খরায় কেমন ক্ষতি হচ্ছে সেটা আরও ভালোভাবে দেখে বলা যাবে। এখন আম আর লিচু রক্ষা করতে সকাল-বিকেল গাছের গোড়ায় পানি দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। বিকেলের পানিটা গোড়ার পাশাপাশি গাছের ওপরেও স্প্রে করে দিতে হবে। তাহলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।’ বোরো ধানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ধানের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। বোরো ধান তো বেশি খরাতেই ভালো হয়। তবে এ জন্য নিয়মিত সেচেরও প্রয়োজন হয়। কৃষকেরা যেন এটা নিশ্চিত করেন। এবিষয়ে তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ আহম্মেদ জানান, যেহেতু তাপদাহ কমের সম্ভবনা নেই, এজন্য মাঠে বাগান মালিকদের গুটি রক্ষার জন্য বিভিন্ন ওষুধ স্প্রে করার পরামর্শের পাশাপাশি গাছের গড়ায় পানিসহ ওষুধ ছেটানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে সামান্য পরিমান বৃষ্টির পানি পেলে গুটি ঝরে পড়বে না। আর বৃষ্টি না হলে ফলন কম হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।