মোঃ সামছু উদ্দিন, নোয়াখালী প্রতিনিধি -ঃ ১৯৬৯ সনে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) আওয়ামী লীগের ৬ দফা সর্বদলীয় ছাত্রদের ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবীতে দূর্বার আন্দোলন চলছিল। এই সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর গুলিতে আসাদ মতিউর এর মতো অনেকে শহীদ হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারীতে ঢাকা সেনানিবাসে নোয়াখালীর কৃতি সন্তান তথা কথিত আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহিরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরই প্রতিবাদে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে ১৯ শে ফেব্রুয়ারী সেনবাগে ধর্মঘটের ঘোষনা দিলেন সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আলী আহমদ ভূঞা। ইতোমধ্যে ১৮ ফেব্রুয়ারীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালরয়ের প্রক্টর ডঃ সামছুজ্জোহাকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় সেনবাগের ধর্মঘট কর্মসূচি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। ১৯শে ফেব্রুয়ারী সেনবাগ হাইস্কুল মাঠে সমাবেশ করে সেনবাগ হাইস্কুল, সেনবাগ মাদ্রাসাএবং সেনবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল সহকারে শেখ মুজিবের আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের জন্য শ্লোগান নিয়ে সেনবাগ থানা সদরের সকল সড়ক প্রদক্ষিন করে। সকল সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলিত হয় কিন্তু সেনবাগ থানাতে কালো পতাকা উত্তোলিত না করায় ছাত্ররা মিছিল সহকারে থানা এলাকায় প্রবেশ করে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ফেলে কালো পতাকা উত্তোলন করতে গেলে পুলিশ বাঁধা দেয়। ছাত্ররা বাঁধা না মানায় পুলিশ বেদম লাঠি পেটা করে। ছাত্ররা থানা এলাকার বাইরে এসে পুলিশদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে এতেও ছাত্ররা দমেনি। এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্র জমায়েত লক্ষ্য করে গুলি করে। আর এতে মাদরাসার ছাত্র আবুল কালামের পেটে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ কালামকে সরকারি দাতব্য চিকিৎসালয়ে (বর্তমান জেলা পরিষদ মার্কেট) নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে জেলা হাসপাতালে রেফার করে দেন। কালামকে মাইজদী নেয়ার পথে চৌমুহনী রেল গেটে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এই খবর সেনবাগের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যায়। সেনবাগের পূর্ব দিক থেকে বাতশিরী ও প্রতাপপুর হাইস্কুল, দক্ষিনে মোহাম্মদপুর হাই স্কুল, উত্তরে কানকিরহাট হাই স্কুল, পশ্চিম দিক থেকে কাজিরহাট হাই স্কুলের ছাত্র সহ হাজার হাজার জনতা সেনবাগ থানা অভিমুখে রওনা হয় এবং চারদিক থেকে থানা ঘেরাও করে ফেলে। থানা এলাকায় প্রবেশ করে খড়ের গাদায় ও একটি খালি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় সংগ্রামী ছাত্র জনতা। পুলিশ এলো পাথাড়ি নির্বিচারে গুলি চালায় এতে অফিজের রহমান (শ্রমিক), খোরশেদ আলম ও সামছুল হক (সেনবাগ হাই স্কুলের ছাত্র) শহীদ হয় এবং ১৭ জন আহত হয়। ঐ সময়ে দেশের কোথাও এতো বড় আন্দোলন এবং এতো বেশী হতাহত হয়নি। এই আন্দোলন ৬৯ গণ অভ্যুত্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ ঘটনা । এর পরপরই শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়। ২২শে ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিব সেনবাগে আসেন এবং অফিজের কবর জেয়ারত করেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারী বিশাল জনসভায় রেইসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবকে ”বঙ্গবন্ধু” খেতাবে ভূষিত করা হয়। গত বছর ফখরুল ইসলাম রচিত “নোয়াখালীতে বঙ্গবন্ধু” বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সেনবাগ লেখক ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ আবু তাহের সেনবাগে বঙ্গবন্ধু আসা প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন। তাঁহার বক্তব্যে ৬৯ এর গণ অভ্যূত্থানে ৪ শহীদ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। সভায় উপস্থিত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান ৪ শহীদের কবর পাকা করার জন্য সেনবাগের উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে তাৎক্ষনিক ভাবে টেলিফোনে নির্দেশ প্রদান করেন। সেমতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জাফর আহমেদ চৌধুরীর মাধ্যমে ৪ জন শহীদের কবর পাকা করনের কাজ সম্পন্ন হয়।