মইনুল ভূইয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া -ঃ- তানিয়া আক্তারের দুই সন্তানের জননী। বড়জন ছেলে, পরে মেয়ে। আবারো ছেলে সন্তানের আশা পরিবারের। ‘কটু’ কথা শুনার ভয়ে প্রসূতিও আশায় ছিলেন ছেলে সন্তানের। প্রবাসে থাকা স্বামীকেও জানিয়ে দেওয়া হয় ছেলে সন্তান হচ্ছে।
গর্ভে মেয়ে সন্তান- আধুনিক চিকিৎসার বদৌলতে জানতে পেরে তানিয়া নানা ফন্দি আঁটতে থাকেন। নিজের সন্তান হওয়ার আগ মুহুর্তে তিনি চুরি করেন আরেকজনের ছেলে সন্তান। অতপর পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে যান তিনি। রাতেই তিনি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।
ঘটনাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। চুরির পাঁচ ঘন্টার মধ্যে রেখা বেগমের নবজাতক উদ্ধারে পুলিশের দায়িত্বশীলতা প্রশংসা পাচ্ছে। অন্যদিকে কন্যা সন্তান হওয়ার শঙ্কা থেকে নারীর এহেন চুরির ঘটনা সংশ্লিষ্টদেরকে নানা দিক থেকে ভাবিয়ে তুলেছে।
ওই দুই নারীসহ তাদের সন্তানরা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডে ঢুকতেই রেখা বেগম ও কয়েকটি বেড পেরিয়ে তানিয়া আক্তার অবস্থান করছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজদের উদ্যোগেই দু’জনকে একটু দূরে সরিয়ে রাখেন। তানিয়া যেখানটায় আছেন এর ঠিক পাশেই ছিলো রেখার শয্যা। তানিয়া রয়েছেন পুলিশের তত্বাবধানে। তার বিরুদ্ধে রেখার স্বামী মামলা দায়ের করেছেন।
বিকেল সাড়ে চারটা। সুনসান নীরবতা। বুঝার জো নেই এখানে কি ঘটেছিল। নবজাতক চুরি হওয়া মায়ের মুখেও নেই কোনো ‘রা’। ফেলফেল করে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। স্বজনরাও ‘থ’ খেয়ে আছেন। চিকিৎসরত অন্যদের মুখে শুধু হাপহিত্যেস। দায়িত্বরতাও মর্মাহত।
সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা। দৃশ্যপটের বদল। ভিড়ে ঠেলে ঢুকতে হয় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডে। সন্তান কোলে মা রেখার চোখে আনন্দাশ্রæ। স্বজনরা দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। মুখে হাসি নেই এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া দায়। উদ্ধার অভিযান বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন পুলিশ।
বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল থেকে নবজাতক চুরির পর পাঁচ ঘন্টার মধ্যে উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্বশীলতার বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। একজন মায়ের কোলে ওরসজাত সন্তান ফিরিয়ে দিতে পেরে পুলিশও নিজেদেরকে ধন্য মনে করছেন।
বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল থেকে রেখা বেগমের তিনদিনের শিশু চুরি হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে ওই শিশুটিকে উদ্ধার করে সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় দিকে মায়ের কোলে তুলে দেয় পুলিশ। ঘটনায় সঙ্গে জড়িত তানিয়া বেগম নামে এক নারীকে আটক করেছে পুলিশ। সিসি টিভির ফুটেজ, মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে ওই নারীর কাছ থেকে শিশুটিকে পুলিশ উদ্ধার করে। আটক তানিয়া বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জেলা সদর হাসপাতালে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।
ঘটনা সম্পর্কে একাধিক সূত্রে জানা যায়, জেলার সদর উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের তেলিনগর গ্রামের কৃষক ফরিদ মিয়ার স্ত্রী ও মজলিশপুর ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামের বাবুল মিয়ার মেয়ে সোমবার প্রসব ব্যথা নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে তিনি সেখানে এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে এক নারী কৌশলে ওই শিশুকে নিয়ে চম্পট দেয়।
রেখার দাদী জুবেদা খাতুন বলেন, ‘আমি শিশুটিকে নিয়ে বসেছিলাম। এমন সময় বোরকা পড়া মাঝ বয়সি এক নারী নিজেকে গর্ভবতী বলে দাবি করেন। এ সময় ওই নারী বলতে থাকেন এখানেই তার প্রসব হবে। যে কারণে হাসপাতালটি দেখতে এসেছেন। তার স্বামী বড়লোক। অনেককে টাকা দেন। তিনিও দান করতে পছন্দ করেন। এসব বলতে বলতে আমার হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেন নবজাতকের মায়ের জন্য যেন ফল নিয়ে আসেন। অনেক আপত্তির পরও ওই নারী জোর করে টাকাটা দেন। টাকা নিয়ে আমি ফল আনতে বাইরে যাই। ১০ বছর বয়সি আমার আরেক নাতিন তৃষার কোলে শিশুটিকে দিয়ে যাওয়া হয়।’
রেখা বেগম জানান, বোরকা পরা ওই নারী বলতে থাকেন নবজাতকের ঠান্ডা লেগেছে। তাই তিনি চিকিৎসা করাতে চান। রেখাকে সঙ্গে তিনি ভালো চিকিৎসকের কাছে যেতে চান। রেখা এতে অপারগতা প্রকাশ করলে শিশু তৃষাকে নিয়ে ওই নারী বের হয়ে যায়। প্রায় এক ঘন্টা পর তৃষা এসে জানায় শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া নারীকে সে খোঁজে পাচ্ছে না। পরে জানা যায় নবজাতককে সন্ধানী নামে একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সটকে পড়েন ওই নারী।
সন্ধানী সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার এন্ড জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ এস এম আব্দুর রহিমের সহযোগি আতিকুর রহমান শিমুল বলেন, ‘দুপুরের দিকে এক নারী নবজাতক নিয়ে এসে ডাক্তার দেখাবেন বলে ৫০০ টাকা ভিজিট দিয়ে সিরিয়াল কাটেন। এক পর্যায়ে সাথে থাকা ১০-১২ বছরের শিশুটিকে সে টয়লেটে যেতে বলে। এরই মধ্যে ওই নারী নবজাতক নিয়ে পালিয়ে যায়। অনেকক্ষণ পর শিশুর মাধ্যমে জানতে পারি সদর হাসপাতাল থেকে নবজাতককে নিয়ে আসা হয়। আমি তখন শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই।’
একই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালে আসার পর আমি ঘটনা জানতে পারি। ওই নারী নবজাতককে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়নি। কৌশলে ওই নারী নবজাতকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এদিকে বোরকা পড়া ওই নারী আর ফিরে না আসায় নবজাতকের স্বজনদের মাঝে সন্দেহ হয়। বিষয়টি তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে অবহিত করে। খবর পেয়ে পুলিশ ছুটে এসে ঘটনা জেনে তৎপরতা শুরু করে। শুরুতেই তারা একাধিক সিসি টিভি ফুটেজ দেখে। এর মাধ্যমে ওই নারী সম্পর্কে ধারণা নেয় পুলিশ। পরে একটি মোবাইল ফোন নম্বরের সূত্র ধরে বেলা সোয়া পাঁচটার দিকে সদর উপজেলার নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নের সিন্দুউড়া গ্রাম থেকে তানিয়া আক্তার নামে ওই নারীসহ নবজাতককে উদ্ধার করে পুলিশ। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে শিশুটিকে হাসপাতালে এনে মায়ের কোলে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মাদ এমরানুল ইসলাম, পরিদর্শক (তদন্ত) সোহরাব আল হোসাইনসহ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডের ইনচার্জ সেবিকা ববিতা রানী দাস বলেন, ‘নবজাতককে ওই নারী নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা কাজে ছিলাম। নবজাতকের স্বজনদের মাধ্যমে চুরির বিষয়টি জানতে পারি। পরে পুলিশ এসে বিস্তারিত জেনে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করে।’
সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মাদ এমরানুল ইসলাম বলেন, ‘নবজাতকে অক্ষত অবস্থায় মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরে আমাদের খুব ভালো লাগছে। আমরা বেশ খুশি। এটা আমার চাকুরি জীবনের সেরা উদ্ধার তৎপরতা।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ‘ওই নারী স্বর্ণের অলংকার বিক্রি করে নবজাতককে সহায়তা করে। আমরা যতটুকু বুঝতে পেরেছি ওই নারী নানা কারণেই চাচ্ছিলেন তার ছেলে সন্তান হোক। প্রবাসী স্বামীকেও ছেলে সন্তান হওয়ার খবর তিনি জানিয়েছেন। এসব কারণেই তিনি ছেলে সন্তানটি চুরি করেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ওই নারী একেক সময় একেক কথা বলছেন বলে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে রেখা বেগমের স্বামী মামলা করেছেন। আমাদের তত্ববধানে হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে।’
রেখা বেগম সন্তানকে কোলে মেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কান্না করছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু আল্লাহ’র উপর ভরসা করছিলাম। সবার দোয়ায় আমি আমার সন্তানকে খোঁজে পেয়েছি। এ জন্য আমি পুলিশসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।’ রেখা জানান, এরফান নামে তার আরেক ছেলে সন্তান রয়েছে।
তানিয়া আক্তার এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘বাচ্চাটা চুরি আমার উদ্দেশ্য না। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। আমি বলে কয়েই ওই বাচ্চাটা নিয়ে গিয়েছিলাম লালন-পালন করার জন্য। কিন্তু কি কারণে এমন করেছি আমি জানি না।’
তানিয়ার মা স্বপ্না বেগম বলেন, ‘চুরি বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার মেয়ে হুট করে আমাকে জানায় যে তার ছেলে হয়েছে। কিন্তু কেন সে এমন করলো আমি জানি না। মেয়ে সন্তান হওয়া নিয়ে কারো কোনো আপত্তির কথাও আমি জানি না। প্রবাসে থাকা তার স্বামীও এ নিয়ে কিছু বলেনি।’
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের অবেদনবিদ সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ওই নারী কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। এ সময় তার এক স্বজন বলছিলো ওই নারীর নাকি ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা। কেন কন্যা সন্তান হলো এ নিয়ে হুল্লোড় করছিলেন তিনি।’